Essay

জাতীয় জীবনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা

জাতীয় জীবনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা

 

স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে

কে বাঁচিতে চায়

দাসত্ব শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে

কে পরিবে পায়?

– রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা –    স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার । একটি সভ্য জাতির কাছে স্বাধীনতার চেয়ে প্রিয় আর কিছু নেই। যে কোন জাতির প্রগতি, উন্নয়ন ও বিকাশের জন্য স্বাধীনতা অপরিহার্য। তাই বাঙালি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় ১৯৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রাম। ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক সে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল যে বোধ বা চেতনাকে কেন্দ্র করে তারই নাম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এই সাহসী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্ররূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ শুধু একখণ্ড ভূমির অধিকার পাবার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। পরাধীনতা মুক্তি দেয়ার পাশাপাশি এই সংগ্রাম অন্য জাতির সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে আমাদের রক্ষা করে জাতি গঠন ও আত্মবিকাশের সুযোগ করে দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাঙালি জাতির প্রেরণারূপে কাজ করে যাবে যুগ যুগ ধরে। এই চেতনা বাঙালি জনগোষ্ঠীকে একতাবদ্ধ করে জাতিকে নিয়ে যেতে পারে চিরকাঙ্খিত উন্নয়নের শীর্ষদেশে। প্রখ্যাত চিন্তাবিদ মনীষী সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী লিখেছেন- আলোক ব্যতীত যেমন পৃথিবী জাগে না, স্রোত ব্যতীত যেমন নদী টিকে না, স্বাধীনতা ব্যতীত তেমনি জাতি কখনো বাঁচিতে পারে না।

 

মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি:

ইংরেজ বেনিয়াশক্তি ১৭৫৭ সনে পলাশীর আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতা হরণ করে প্রায় দীর্ঘ দুশ বছর দেশমাতৃকাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে রাখে। শোষণ- শাসনে, লুণ্ঠনে তারা ছিল সিদ্ধহস্ত কিন্তু বিশ শতকের বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের জাগরণে ইংরেজ রাজত্ব ভারতবর্ষ থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হয় । ১৯৪৭ সনে বাংলাদেশ অঞ্চল পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়। জাতিগঠনের দিক থেকে পাকিস্তান ছিল এক অদ্ভূত সৃষ্টি। ১৯৩২ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত দুটি ভূখণ্ড নিয়ে একটি রাষ্ট্র গঠন করা হয়েছিল মূলত ধর্মীয় ঐক্যের বিচারে রাজনৈতিক বিচারে একই রাষ্ট্রের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান এই দুই অংশের জনগণের ভাষা, সাহিত্য সংস্কৃতি এবং মানবিক গঠনের দিক থাকে নিজেস্ব আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র বিদ্যমান ছিল। দেশের মানুষের ধর্মীয় অনুভূমি প্রবল হওয়ায় ধর্মকেই শোষণ ও বঞ্চনার হাতিয়ার রূপে ব্যবহার করা হয়েছিল। নতুন পাকিস্তান রাষ্ট্রটির পশ্চিমাঞ্চল পূর্ব পাকিস্তানের উপর ঔপনিবেশিক শাসনের তাণ্ডবে মেতে উঠেছিল রাষ্ট্রীয় প্রশাসন, অর্থনীতিতে তারা একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে বাঙালিকে শোষণ ও অত্যাচারে মেতে উঠেছিল। সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে তারা বাঙালিকে হীনবীর্য করে তোলার অপপ্রয়াসে লিপ্ত হয়। কিন্তু বাঙালি পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠতে থাকে ।

 

ভাষা আন্দোলন:

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্রমধারায় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এক তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়। এই আন্দোলনের মাধ্যমেই স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ উপ্ত হয়েছিল । ভাষা জাতীয় চেতনার প্রধান ধারক। তাই পশ্চিম পাকিস্তানীরা দেশ বিভাগের পর পরই আঘাত হানে আমাদের ভাষার উপর। ১৯৪৮ খালের কেবল উর্দুভাষকে রাষ্ট্রভাষার ঘোষণা দেয়া হলে দেশপ্রেমিক পূর্ব পাকিস্তানী বাঙালি ছাত্র-জনতা প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি উত্তাল গণআন্দোলনে বাংলাদেশ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। আন্দোলন স্তব্ধ করে দেবার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানি সরকার ছাত্র-জনতার উপর গুলি চালায় এতে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারসহ আরো অনেক তরণের উষ্ণশোণিতের বিনিময়ে বাঙালির মাতৃভাষা বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে স্বীকৃত হয়।

 

শোষণ-বঞ্চনা এবং ধারাবাহিক আন্দোলন:

ইংরেজ শাসনের শৃঙ্খলা থেকে মুক্ত হলেও ২৪ বছরের পাকিস্তানী শাসনামলে বাঙালি বঞ্চিত এবং অত্যাচারিতই থেকে গিয়েছে। পাকিস্তানি শাসকদেরও ছিল সেই একই ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গি। ভাষা আন্দোলনের প্রত্যক্ষ প্রভাব লক্ষ করা যায় ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে। শোষণ ও বঞ্চনা বাঙালির মনে বিক্ষোভ ও বিচ্ছিন্নবাদ তথা স্বাধীনতা সংগ্রামী মনোভাব জাগিয়ে তোলে। ৫২-র ভাষা আন্দোলনেই বাঙালি থেমে থাকেনি এর পর এক এক করে ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান পাকিস্তানী শাসকদের শঙ্কিত করে তুলেছিল। এছাড়া ১৯৬৬ সালে পূর্বপাকিস্তানের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ বাঙালির স্বাধিকারের দাবিতে ‘ছয়দফা’ উত্থাপিত করে । ১৯৭০-৭১ সালের ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল তাতে বাঙালির স্বাধীকার চেতনার প্রতিফলন ঘটে। এখানে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের ১৬৯ টি আসনের মধ্যে ১৬৭ টিতে জয়ী হয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকদের ষড়যন্ত্রে ৩ মার্চ আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য মূলতবি ঘোষণা করা হয় । তখনই বাঙালি বুঝে নেয় স্বাধীনতা আন্দোলন ছাড়া নিজেদের অধিকার রক্ষার আর কোন উপায় নেই । click here

 

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ

১৯৭০ সালের নির্বাচন ৬ দফার স্বাধিকার দাবির ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। বাংলার মানুষের এই বিজয়কে কেন্দ্রীয় সরকার নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গণপরিষদ অধিবেশন স্থগিত করার সাথে সাথেই গোটা পূর্ব বাংলা গর্জে উঠে। শেখ মুজিবুর রহমানের অসহযোগ আন্দোলনে সারা বাংলার জীবন স্তব্ধ হয়ে গেল। পাকিস্তানী স্বৈরাচারদের দুরভিসন্ধি বুঝতে পেরে তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সনের ঐতিহাসিক ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে লক্ষ লক্ষ সংগ্রামী জনতার সামনে বাংলাদেশের মুক্তি তথা স্বাধীনতার অভিপ্রায় বজ্রকণ্ঠ ঘোষণা করেন: ‘

এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।

এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”

বজ্রকণ্ঠের সেই গর্জন বাংলার ঘরে ঘরে বেজে উঠতে থাকে যুদ্ধের দামামা।

সারা বাংলাদেশে শ্লোগান উঠে:

বীর বাঙালি অস্ত্র ধর

বাংলাদেশ স্বাধীন কর।

সারা দেশ বারুদের মতো জ্বলে উঠে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর নেতৃত্বে সমগ্র বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদকে চিরতরে ধ্বংস করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার দীর্ঘদিন যাবৎ শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আপস আলোচনার প্রহসন চালায় ।

 

১. পৈশাচিক কালোরাত্রি:

একদিকে আপস আলোচনার নামে প্রহসন অন্যদিকে আলোচনার অন্তরালে পশ্চিম পাকিস্তানিরা পশ্চিম পাকিস্তান প্রচুর সৈন্য ও অস্ত্র পাঠাতে থাকে। প্রেরিত সেই বিপুল অস্ত্র ও সৈন্য নিয়ে ২৫ মার্চের কালো রাত্রিতে আকস্মিকভাবে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র বাঙালি জাতির মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। ২৬ শে মার্চ তারিখে বঙ্গবন্ধু স্বাধিনতা ঘোষণা দেন। ক্ষমতালিপ্ত পাক সামরিকজান্তা শেখ হিংস্র হায়েনার মতো পঁচিশ মার্চ রাতে বাঙালি জাতির উপর অত্যাধুনিক রণসম্ভার নিয়ে হত্যাযজ্ঞের পৈশাচিক উল্লাসে মেতে উঠে। হাজার হাজার প্রাণ রাতের আঁধারে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। নিরীহ জনসাধারণের এতে রক্তপাত মানব সভ্যতার ইতিহাসে বিরল। পথচারী, ঘুমন্ত নারী কি শিশু ছাত্রাবাস, মসজিদ, মন্দির, ঘাতকদের ঝকঝকে অস্ত্রের সামনে কোনো মূল্যই পেলো না। ঢাকা পৃথিবীর সেরা কসাই খানায় পরিণত হলো।

 

২. স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র:

২৬ মার্চ ১৯৭১ । দুপুর প্রায় দুটোর সময় তখনকার চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে দখলদার বাহিনীকে সর্বশক্তি দিয়ে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান প্রচারিত হল। গোটা জাতি যখন ইয়াহিয়া খানের লেলিয়ে দেওয়া হানাদার বাহিনীর খপ্পরে নিষ্পেষিত এবং নির্যাতিত সে সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্ম। নয়টি মাস উৎসাহ উদ্দীপনা এবং প্রেরণা জুগিয়েছে এই বেতার কেন্দ্র। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জঙ্গি অনুষ্ঠান মুক্তিযোদ্ধাদের অপরিমেয় উৎসাহ দিয়েছে। এর ইংরেজি ও উর্দু অনুষ্ঠান হানাদার বাহিনীর মনোবল ভেঙে দিতে সাহায্য করেছিল। এতে কোন সন্দেহ নেই। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংবাদ বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা প্রভৃতি মাধ্যমেই গোটা পৃথিবীতে প্রচার হয়ে যেতো খুব সহজেই।

 

স্বাধীনতা ঘোষণা:

কালুর ঘাটে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ১৯৭১ সনের ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা এবং মুক্তিযুদ্ধের ডাক জিয়াউর রহমান বিশ্ববাসীকে পাঠ করে শুনান। হানাদার বাহিনীর আকস্মিকভাবে ঝাপিয়ে পড়া গণহত্যার নির্মম মুহূর্তে চট্টগ্রামে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে এই প্রচার গোটা জাতিকে আত্মবিশ্বাস পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে, শত্রুর বিপক্ষে মরিয়া হয়ে আঘাত হানার ক্ষেত্রে এবং ঐক্যবদ্ধ হতে প্রভূত সাহায্য করেছিল।

 

মুজিবনগর সরকার:

১৭৫৭-র ২৩ জুন পলাশির আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। কাছাকাছি আরেক আম্রকানন রণাঙ্গনের কাছেই, শান্ত, স্নিগ্ধ বি জীবনানন্দীয় একটি গ্রাম বৈদ্যনাথতলা। বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরের অন্তর্গত ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল শনিবার। আজ থেকে এই গ্রামটির নাম হল মুজিবনগর। জন্ম নিলো নতুন একটি রাষ্ট্র, বাংলাদেশ নতুন সরকার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।

 

মুক্তিযুদ্ধ:

“বন্ধু তোমার ছাড়ো উদ্বেগ,

সুতীক্ষ করো চিত্ত,

বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি

বুঝে নিক দুর্বৃত্ত।

নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের ছত্রছায়ায় মুক্তিপাগল এদেশের ছাত্র-জনতা সাহসী চিত্তে গড়ে তোলে মুক্তিবাহিনী। ইয়াহিয়া খানের ‘অপারেশন ব্রিজ’ যা নির্মম পৈশাচিক গণহত্যা ছাড়া আর কিছুই ছিল না, তা বাংলাদেশের মানুষকে। হতবুদ্ধি করে দিলেও মনোবল ভাঙতে পারেনি। টিক্কা খানের হুক্কার:

“মিটিং মাঙতে হায়,আদমি নেহি

বাঙাল অদিমি লোগকে সাফা করো”।

দম্ভোক্তি হয়ে রইল । স্বতস্ফূর্তভাবে ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলস ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ছুটি ভোগরত সৈনিক, অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক, সশস্ত্র পুলিশ, আনসার মুজাহিদ এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন শ্রেণির ছাত্র-যুবক-জনতা পাক হানাদারদের প্রতিহত করার জন্য এবং দেশ থেকে সম্পূর্ণ উৎখাত করার মরণপণ লড়াইয়ে নেমে যায় । পৃথিবীর ইতিহাসে যে কয়েকটি সশস্ত্র বিপ্লব হয়েছে তাতে আমরা লক্ষ করেছি যে প্রথমে অর্গানাইজার করা হয়েছে এবং পরবর্তীতে ঘোষিত হয়েছে বিদ্রোহ, অতঃপর বিপ্লব। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি ঘটে সম্পূর্ণ বিপরীত। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রথমে ঘোষিত হয়েছে বিদ্রোহ, পরে হয়েছে সংগঠন।

মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ এগারটি সেক্টরে বিভক্ত হল। সেনাবাহিনীর অফিসাররা এসব সেক্টরের কমান্ড গ্রহণ করলেন। দুধর্ষ গেরিলা বাহিনী সংগঠিত হল। গেরিলা যুদ্ধ পদ্ধতি হচ্ছে চোরা-গোফতা অতর্কিত আক্রমণ এবং পলায়ন। সম্মুখ যুদ্ধ এবং গেরিলা আক্রমণের মাধ্যমে সমগ্র বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনী পাকবাহিনীকে পর্যদস্ত করতে থাকে। দেশের সমস্ত শহর ও গ্রামাঞ্চলই পরিণত হয় যুদ্ধক্ষেত্রে। এ যুদ্ধের আক্রমণে দিশেহারা হয়ে উঠে পাকিস্তানি বাহিনী। পাকিস্তানের রণ উন্মত্ততাকে সহায়তা করে আমেরিকা ও চীন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করে সোভিয়েত রাশিয়া। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সাহায্যের মাধ্যমে রাশিয়া বাংলাদেশ ও ভারত সরকারকে অনুপ্রাণিত করে ।

 

মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র সমাজ:

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র সমাজ বিস্ময়কর ভূমিকা পালন করেছে। জাতি তাদের কথা কখনও ভুলবে না মুক্তিবাহিনীতে শতকরা ৭০ ভাগই ছিল ছাত্র সমাজ। পূর্বে কোন অভিজ্ঞতা না থাকলেও শুধু দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েই তারা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল। যুদ্ধ করতে গিয়ে বহু ছাত্রকে অকালে প্রাণ হারাতে হয়েছে। বুকের রক্ত দিয়ে ছাত্র সমাজ বাংলাদেশের পরাধীনতার অপরাধ দূরীভূত করেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্র সমাজের এ অবদানের কথ চিরকাল স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে।

 

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্বরূপ:

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাঙালিকে শোষণ ও অত্যাচার থেকে মুক্তি দিয়েছে। ধর্মীয় কুসংস্কারের উর্ধ্বে উঠে হাজার বছরের বাঙালি পরিচয়কে প্রধান বিবেচনা করে হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান একই পতাকাতলে সমবেত হয়েছে। এই একতা দেশ গঠনে বাঙালিকে নতুন প্রেরণা দান করে। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের আর্থ-সামাজিক সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নতুন প্রাণময়তা সৃষ্টি করে। স্বাধীনতার পর কাব্য, উপন্যাস, নাটক সর্বক্ষেত্রে অনেক আমার প্রতিফলন দেখা দেয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমাদের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে সমৃদ্ধ করে তুলতে সহায়তা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রায় তিন দশক পরে দেখা যায়, স্বাধীনতা প্রাপ্তি একই সঙ্গে আমাদের আনন্দের এবং দুঃখের ইতিহাস। একটি মর্যাদাবান জাতি হিসেবে বিশ্বের কাছে নিজেদের উপস্থাপন করা আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার লাভ এসবই সম্ভব হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের কল্যাণে। পাশাপাশি একথাও সত্য যে, মুক্তিযুদ্ধের ফসল আমরা যথার্থভাবে তুলে নিতে পারি নি। আমাদের অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতা দেশের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করবার পেছনে একটি বড় অন্তরায়। আর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে পিছিয়ে রেখেছে জাতীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে মতানৈক্য এবং সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের নানা অস্থিরতা। অন্যদিকে অনেক সময় সাম্প্রদায়িকতা ক্ষতিগ্রস্ত করছে শুভ চেতনাকে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমাদের এসব দুরবস্থা থেকে মুক্তি দিয়ে জাতীয় সংহতি এবং নৈতিকতাকে সুদৃঢ় করতে পারে। ১৯৭১ সালে বাঙালি জাতি যে দেশপ্রেম, অকুতোভয় সাহস এবং সুদৃঢ় একতা নিয়ে পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়েছিল সেই চেতনাকে জাগ্রত রাখতে পারলে জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি দৃঢ়তা অর্জন করবে। দেশের সব শ্রেণির মানুষের কাছে স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তুলতে হলে আর্থ-সামাজিক দিক থেকে অগ্রগতি অর্জন করতে হবে। দেশেপ্রেম এবং জাতীয় সংহতি এক্ষেত্রে অত্যাবশ্যক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই পারে আমাদের সব বিভেদ ভুলিয়ে দেশপ্রেমিক বাঙালি হিসেবে লাল- সবুজ পতাকার তলে সমবেত করতে। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হওয়া আজ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।

 

বাংলা সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাঃ

বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য মুক্তিযুদ্ধ নিঃসন্দেহে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। মুক্তিযুদ্ধ যেমন আমাদের সাহিত্য অঙ্গনে নতুন প্রাণ প্রবাহ সৃষ্টি করেছে সাহিত্যিকদের নব সৃষ্টিতে উদ্বুদ্ধ করেছে, একইভাবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সাহিতকর্ম আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন করে দেশকে ভালবাসতে শেখায়। এই সচেতনতা ও দেশপ্রেম দেশ গঠনের জন্য অত্যন্ত জরুরি। তবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সাহিত্য রচনার সময় শেষ হয়ে গিয়েছে একথা ভাববার কোন অবকাশ নেই। মুক্তিযুদ্ধ যেহেতু বাঙালি জাতির জন্য যুগ যুগান্তর ধরে প্রেরণারূপে কাজ করবে তাই এ বিষয়ক সাহিত্য রচনার সম্ভাবনাও থেকে যাবে দীর্ঘকাল। এভাবে আমরা হয়তো একদিন এমন একটি সাহিত্যকর্ম পেয়ে যাব যা বিশ্ববাসীর কাছে বাঙালি জাতিকে নতুন রূপে নতুন মর্যাদায় চিনিয়ে দিতে পারবে ।

 

মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব ও চেতনার বিকাশ:

বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের আত্মত্যাগ থেকে যে চেতনা লাভ করেছে তা জাতির সকল আন্দোলনে প্রেরণা হিসেবে কাজ করছে। সমগ্র জাতি একতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে এই যুদ্ধের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। ঐক্যবদ্ধ জাতি দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছে। তার পেছনে মুক্তিসংগ্রামের আত্মত্যাগ কাজ করছে। অত্যাচার আর শোষণের কালো হাত গুড়িয়ে দেয়ার শক্তি প্রেরণা এসেছে এই স্বাধীনতার যুদ্ধ থেকে। বাংলাদেশের মানুষের স্বজাত্যবোধের স্ফুরণের উৎস এই যুদ্ধ । ৭১ সাল দেশে ও জাতির নতুন ইতিহাসের জন্মদাতা। অধিকার আদায়ের জন্য আত্মসচেতন হওয়ার প্রেরণা দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ এই দিনগুলোতে মানুষ নতুন করে জেগে উঠেছিল। সে জাগ্রত চেতনা ছড়িয়ে গেছে বাংলাদেশের মানুষের পরবর্তী কর্মকাণ্ডে।

গত তেতাল্লিশ (৪৩) বছর ধরে নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকশিত হয়েছে আমাদের সমাজজীবনে। ব্যক্তিস্বাধীনতা, নারীমুক্তি আন্দোলন, নারীশিক্ষা, গণশিক্ষা, সংবাদপত্রের ব্যাপক বিকাশ, সর্বোপরি গণতান্ত্রিক অধিকার চেতনা ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি লাভ করেছে সমাজে। এরশাদ সরকারের নয় বছরে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে যে প্রবল গণজোয়ারের মধ্য দিয়ে নবতর বিজয় অর্জন ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে তারও প্রেরণা যুগিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমাদের সাহিত্যে বিশেষ করে কবিতা ও কথাসাহিত্যে এক নবতর সাহিত্য ধারার জন্য দিয়েছে। বাংলাদেশে কবিতা চর্চা ও কথাসাহিত্য চর্চা আজকে যতটা ব্যাপ্তি পেয়েছে তার পেছনে বড় প্রেরণা ছিল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমাদের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে প্রকাশিত হয়েছে গানে এবং নাটকে। গণসচেতনতামূলক বক্তব্যধর্মী নাটক ব্যাপকভাবে রচিত হয়েছে স্বাধীনতার পর। আমাদের দেশাত্মবোধক গানের ক্ষেত্রে এক নতুন জোয়ার এনেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। অসংখ্য গীতিকার রচনা করেছেন মুক্তিযুদ্ধে বিজয়গাঁথা তাদের গানে। তবে আমাদের চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আশানুরূপভাবে প্রতিফলিত হয়নি। খুব সামান্য সংখ্যক চলচ্চিত্রেই মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা প্রকাশ পেয়েছে।

 

রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রতিফলন:

যে স্বপ্ন বা আকাঙ্ক্ষা সামনে রেখে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল সেই স্বপ্ন নানা কারণেই গত তেত্রিশ বছরেও সাফল্যের লক্ষ্যমাত্রা স্পর্শ করতে পারেনি। স্বাধীনতার পর বার বার সামরিক অভ্যুত্থান, হত্যা আর রক্তপাতের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী দেশী ও বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীদের তৎপরতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, যুবসমাজের মধ্যে সৃষ্ট হতাশা, বেকারত্ব, জনস্ফীতি, আইন-শৃঙ্খলার অবগতি, ঘুষ, দুর্নীতি ইত্যাদি অবক্ষয় স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বিপন্ন করে চলেছে। প্রতিটি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সভা-সমিতি, বিবৃতিতে বারবার যে কথাটি সবচেয়ে বেশি উচ্চারণ করেছেন তা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখার কথা অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কার্যকলাপ বারবার সংঘটিত হয়েছে প্রশাসনের ভেতরে এবং বাইরে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা প্রাপ্য সম্মান এবং অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, গত তেত্রিশ বছরে।

 

উপসংহার:

“তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,

শহরের বুকে জলপাই রঙের ট্যাঙ্ক এলো

দানবের মতো চিৎকার করতে করতে…

………………………………………………

…………………………………………………

তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা

অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিলো পিতামাতার লাশের ওপর।”

পর্বত প্রমাণ বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। স্বাধীনতা অর্জনের পর তেতাল্লিশ বছর অতিক্রান্ত হতে চলল। কিন্তু স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ এখনো আমরা পাইনি। তদুপরি স্বাধীনতা ও আমাদের সংস্কৃতি বিরোধী একটি চক্র দিন দিন মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। তাই আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল চেতনা অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আমাদের মনে সমুন্নত রাখতে হবে। স্বাধীনতার ফল সবার জীবনে পৌঁছে দিতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন অর্থনৈতিক মুক্তি। কারণ অর্থনৈতিক মুক্তি না এলে রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন। আর এই অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করতে হলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কর্মমুখর হয়ে উঠতে হবে।

  • জাতীয় জীবনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা
  • জাতীয় জীবনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা
  • জাতীয় জীবনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা
  • জাতীয় জীবনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা
  • জাতীয় জীবনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা

 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button