
স্বদেশ প্রেম রচনা বাংলা।Swadesh Prem Essay in Bangla – সকল শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য।
|
|
স্বদেশ প্রেম রচনা বাংলা।Swadesh Prem Essay in Bangla
ভূমিকা:
কোনো মানুষই স্বাধীনতা ছাড়া জীবনযাপন করতে চায় না। প্রতিটি মানুষই তার মাতৃভূমিতে স্বাবলম্বী হতে চায়। তাই দেশপ্রেমিকরা তাদের দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় সদা প্রস্তুত। দেশপ্রেম হলো দেশের মাটি ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা, নিজের দেশের প্রতি প্রকৃত মমতায় হৃদয়ের গভীর থেকে জন্ম নেওয়া। প্রজ্জ্বলিত আলোর মতো প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে এই অনুভূতি জাগে। নিজের জাতিকে না ভালবাসার জন্য একজন ব্যক্তির লজ্জা ক্ষমার অযোগ্য। আমরা আমাদের জাতির আলিঙ্গনে ধীরে ধীরে পরিপক্ক হচ্ছি। আমাদের দেশের আলো, জল, মাটির স্পর্শে আমাদের দেহ ও মন ভরে ওঠে। মানুষ সারাজীবন স্বদেশের হৃদয়ে গর্বিতভাবে বেঁচে থাকতে চায় এবং তাদের জাতির হৃদয়ে মরবে এই আশা প্রকাশ করে। আমাকে ধরো, আমাকে এদেশে মরতে দাও।
“স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে কে বাঁচিতে চায় ? দাসত্ব শৃঙ্খল বল, কে পরিবে পায় হে কে পরিবে পায়? – রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়
দেশপ্রেম কি:
সমাজে বসবাস করাই মানুষের ধর্ম। সমাজগুলি আবার স্বাধীন বা অনন্য সরকার বা জাতিতে বিভক্ত, নির্দিষ্ট ভাষা, ধর্ম এবং অঞ্চলগুলির জন্য ভৌগলিক সীমারেখা স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের বাসিন্দাদের মধ্যে একত্ববোধ জাগ্রত হলেই জাতির ব্যক্তিত্বের বোধ শক্তিশালী হতে পারে। দেশপ্রেম, বা জাতীয়তাবোধ বা দেশপ্রেম, এই একতাকে দেওয়া লেবেল। প্রকৃতপক্ষে, ভৌগলিক সীমানা, ঐতিহ্য, ইতিহাস, ভাষা, প্রাকৃতিক সম্পদ, ধর্ম এবং অন্যান্য কারণগুলি দেশপ্রেমে অবদান রাখে। একজন দেশপ্রেমিক ব্যক্তির তার জাতি বা মাতৃভূমিকে নিজের মনে করার ক্ষমতা বা সবকিছুকে নিজের হিসাবে দেখার ক্ষমতা একটি স্বতন্ত্র গুণ। মানুষের এই বৈশিষ্ট্য দেশপ্রেম নামে পরিচিত।
দেশপ্রেমের প্রকারভেদঃ
দেশপ্রেম শুধু নিজের জাতির প্রতি ভালোবাসার চেয়েও বেশি কিছু। প্রাচ্য ও পশ্চিমের শিল্পোন্নত দেশগুলোর কাছে দেশের অবস্থান সবচেয়ে বেশি। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশেই দেশের ভালোর জন্য সর্বস্ব উৎসর্গ করার ইতিহাস রয়েছে। সঙ্কট, দুর্যোগ বা বিপদের সময় প্রতিটি দেশপ্রেমিক মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশকে সমর্থন করে। কারণ তারা বোঝে যে একটি দেশ ভালো থাকলে তার নাগরিকরাও ভালো থাকবে। ফলে দেশকে অসম্মান ও অপমানমুক্ত রাখা সবার নৈতিক দায়িত্ব। সেজন্য যারা দেশকে তুচ্ছ বা হেয় প্রতিপন্ন করে তারা সকলের কাছে তুচ্ছ। দেশপ্রেম একটি দেশের উন্নয়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গদাপি গরিয়াসিঃ
মা ও মাতৃভূমি, সংস্কৃত কবিদের মতে স্বর্গের চেয়েও উত্তম। জন্মভূমি মাতৃভূমির মতোই আমাদের জন্মের সময় তার স্তন ও স্নেহ দিয়ে আমাদের লালন-পালন করে এবং সবাইকে খাদ্য ও ভরণ-পোষণ দেয়। ফলে জননীর মতো সকল মানুষের কাছে মাতৃভূমিই শ্রেষ্ঠ। স্বনামধন্য কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার গানে মাতৃভূমির এই শ্রেষ্ঠত্বকে ধারণ করেছেন, আমার দেশের মাটি তোমার পরে মাথা। (স্বদেশ প্রেম রচনা বাংলা)
দেশপ্রেমিকের অবদান:
দেশের অভ্যন্তরে বসবাসকারী প্রত্যেক ব্যক্তি এটিকে পছন্দ করে। অন্যদিকে কিছু মানুষ বিভিন্ন যুগে জন্ম নিয়ে দেশপ্রেমের ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। ইতিহাসের পাতায় তাদের কর্মময় জীবনের অপূর্ব নিদর্শন স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। সারা বিশ্বের বহু মানুষ দেশের জন্য তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জর্জ ওয়াশিংটন, মহাত্মা গান্ধী, ভ্লাদিমির লেনিন, মাও সেতুং, ইয়াসির আরাফাত, নেলসন ম্যান্ডেলার মতো নেতারা দেশ প্রেমের জন্য দীর্ঘ সময় কারাগারে কাটিয়েছেন। শাসক শ্রেণীর অত্যাচার ও ভয়ংকর নিপীড়ন সত্ত্বেও তারা দেশ ও জাতির মুক্তির সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বিশেষ করে ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সমগ্র বাংলাদেশি জনগণ শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা হরণ করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা মূলত ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেশপ্রেমের চূড়ান্ত পরিণতি।
দেশপ্রেমের জাগরণে সাহিত্য:
দেশপ্রেম ইতিহাস, ঐতিহ্য, পণ্ডিত উচ্চারণ, বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বাংলা ও বিশ্বসাহিত্যেই স্বদেশের প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন রয়েছে। মধ্যযুগীয় কবি আবদুল হাকিম তাঁর ‘নূরনামা’ থেকে ‘বঙ্গবাণী’ কবিতায় দেশের প্রতি তাঁর নিরঙ্কুশ বিশ্বাস ও ভালোবাসার কথা জানিয়েছেন। যারা দেশকে ভালোবাসে না তাদের উদ্দেশে তিনি আরও বলেন, কার জন্ম আমি জানি না। “বাংলার মুখ দেখেছি, তাই আর পৃথিবীর রূপ খুঁজতে যাই না,” বলেছেন কবি জীবনানন্দ দাশ, বাংলাদেশের প্রতি তার হৃদয় ভরা ভালোবাসা। “আমাদের বসুন্ধরা ধন-সম্পদে পরিপূর্ণ,” কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায় সুন্দর বাংলার প্রেমে মুগ্ধ হয়ে গেয়েছিলেন। (স্বদেশ প্রেম রচনা বাংলা)
দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে আমাদের যা করতে হবে:
ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি সবই দেশপ্রেমের প্রয়োজনের সাথে জড়িত। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ব্যক্তিরা যেভাবে আচরণ করুক না কেন দেশপ্রেমের প্রকৃতি একই। জাতীয় জীবনে প্রতিটি মানুষই দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ। যে কোনো জাতি তখনই উন্নতি করতে পারে যখন তার নাগরিকরা নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক হয়। আমাদের ভাষা আন্দোলন স্বার্থহীন দেশপ্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। মাতৃভূমির প্রতি বাংলার মানুষের সত্যিকারের স্নেহের ফলে বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিক প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের ফলে আমরা আমাদের স্বাধীনতা পেয়েছি। যে কোনো মূল্যে মাতৃভূমির মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলার মানুষ প্রশংসার দাবিদার।
দেশপ্রেম এবং বিশ্বজনীনতা:
নিঃস্বার্থ একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিকের মানসিকতায় সংকীর্ণতা কখনই শিকড় গাড়তে পারে না। নিজের দেশকে ভালোবাসা নৈতিক দায়িত্ব, কিন্তু অন্য দেশের জন্য শত্রুতা লালন করা নৈতিক দায়িত্ব নয়। শুধুমাত্র নিজের দেশের কথা চিন্তা করা কখনোই প্রকৃত দেশপ্রেম নয়। নিজের সীমানার বাইরে সমগ্র বিশ্বকে একটি দেশ হিসেবে ভাবতে পারা মহান দেশপ্রেমের লক্ষণ। ফলস্বরূপ, আমাদের অবশ্যই আমাদের দেশকে ভালবাসতে হবে এবং বিশ্বের সমস্ত দেশের প্রতি আমাদের সহানুভূতি বজায় রাখতে হবে। কারণ একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক কখনো নিজেকে গুটিয়ে রাখেন না, তিনি নিজেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়াকে সফল বলে মনে করেন। (স্বদেশ প্রেম রচনা বাংলা)
উপসংহার:
যে ব্যক্তি তার জাতিকে ভালবাসে না সে পশুর সমতুল্য। দেশপ্রেম মানুষের চেতনার একটি সর্বোচ্চ রূপ। এটি মানুষকে ধর্মীয়, বর্ণ এবং জাতিগত কুসংস্কার থেকে মুক্ত করে। সত্যিকারের দেশপ্রেমিকরা নিজেদের স্বার্থের চেয়ে দেশের স্বার্থকে এগিয়ে রাখেন। ফলস্বরূপ, আমাদের সকলেরই নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম প্রদর্শন করা উচিত। দেশপ্রেমকে শুধু কথায় নয়, মস্তিষ্কে, মননে, চিন্তায় ও কাজে মূল্যায়ন করতে হবে। তাহলেই আমাদের বাংলাদেশ গৌরবময় বাংলায় রূপান্তরিত হবে।